আজ মঙ্গলবার ২৪শে বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ, ৭ই মে, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ

শিরোনাম:
তারাকান্দায় অগ্নিকাণ্ডে ক্ষতিগ্রস্তদের মাঝে ব্র্যাকের অর্থ সহায়তা গৌরীপুরে কর্মরত সাংবাদিকদের স্মারকলিপি তারাকান্দায় বাট্টাভাটপাড়া এস.সি উচ্চ বিদ্যালয়ের সভাপতি ও প্রধান শিক্ষককে সংবর্ধনা গৌরীপুরে শ্রেষ্ঠ শিক্ষক-শিক্ষার্থী হলেন যাঁরা তারাকান্দায় মোটরসাইকেল দূর্ঘটনা বাড়ছে ময়মনসিংহ সদর উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে ঘোড়া প্রতীক নিয়ে আশরাফ তুঙ্গে ওমরা হজ্জে নেয়ার প্রলোভনে,প্রতারনা ও অর্থ আত্মসাতের অভিযোগে গ্রেপ্তার ২ তারাকান্দায় দু’মোটরসাইকেলের সংঘর্ষে নিহত-১ মে দিবসে গৌরীপুরে ডেকোরেটর কারিগর শ্রমিক ইউনিয়নের বর্ণিল শোভাযাত্রা মহান মে দিবসে রাজ ওস্তাগার নির্মাণ শ্রমিক ইউনিয়নের উদ্যোগে গৌরীপুরে বর্ণিল শোভাযাত্রা
||
  • প্রকাশিত সময় : ফেব্রুয়ারি, ৭, ২০২০, ৪:০০ অপরাহ্ণ




মানুষের হৃদয় স্পর্শ করেছিলেন, পকেট স্পর্শ করেননি

মো. রইছ উদ্দিন ঃ
স্তম্ভিত আমি! মুঠোফোনের অপর প্রান্ত থেকে আসা কন্ঠধ্বনি শোনে ক্ষণকালের জন্য বাকরুদ্ধ হয়ে পড়লাম। মুঠোফোনে ছিলেন তিলক রায় টুলু। জানালেন, জাফর ভাই নেই। কয়েক সেকেÐের জন্য থমকে গেল আমার পৃথিবী। অবিশ্বাস্য এই তথ্যের সত্যতা যাছাই করতে আবারও জিজ্ঞাসা করলাম, কে বলেছে? শতভাগ নিশ্চয়তার স্বরে বললেন, ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে মারা গেছেন। ধর্মীয় চিরায়ত বাক্য, ইন্নালিল্লাহে ওয়াইন্না ইলাইহে রাজিউন পড়লাম। স্মৃতির পাতায় ভেসে উঠলো, আমি ও জাফর ভাই! উচ্চকন্ঠের সেই প্রাণখোলা হাসি আর শোনতে পাব না, মুঠোফোনে আর কখনও ভেসে উঠবে না জাফর ভাইয়ের নাম ।
মফস্বলের সাংবাদিক আবু জাফর তালুকদার, ঐতিহ্যবাহী সংবাদপত্র ‘দৈনিক সংবাদ’ এর পূর্বধলার মুখপাত্র ছিলেন। ‘দৈনিক সংবাদ’-এ তিনি আজ কালের সাক্ষী । স্বনামধন্য এ পত্রিকার সম্মানজনক অবস্থানই রক্ষা করে গেছেন তিনি। মফস্বলের অপসাংবাদিকতার ¯্রােতে তিনি নিজেকে ভাসিয়ে দেননি। প্রায়শঃ সংবাদ নিয়ে কথা হতো। সাংবাদিক পরিচয় দিতেই সংকোচবোধ করতেন। মাঝে নিজেকে অনেকটা গুটিয়ে নিয়েছিলেন। একজন সাংবাদিক যে গর্বে পাশের মানুষটিকে ঠেলে সামনে যান, তার মাঝে সেই অহংকারবোধ ছিল না। আপদমস্তক সংবাদ ও সাংবাদিকতার এই মানুষটি কতটুকু গ্রহণযোগ্য ছিলেন তা আজ সহজেই অনুমেয়। সেই মানুষটি ৯ ফেব্রæয়ারি/১৬ মঙ্গলবার রাত ৮টা ২০মিনিটে আমাদের ছেড়ে চলে যান না ফেরার দেশে।
উপজেলা সদর থেকে প্রায় ১৩ কিলোমিটার দূরে প্রত্যন্ত অঞ্চলে থাকতেন জাফর ভাই। গোয়ালাকান্দা ইউনিয়নের শালদিঘা গ্রাম। ময়মনসিংহ-পূর্বধলা সড়ক থেকে মাত্র দু’মিনেটের পথ। প্রায়শই আড্ডায় সময় কাটাতেন শ্যামগঞ্জ বাজারের রায় মেডিকেল হলে। তার আড্ডায় গেলাম, কিন্তু সেখান থেকে তার বাড়ি মাত্র কয়েক মিনিটের পথ, তবু তার বাড়িতে যাওয়া হয়নি। যেদিন গেলাম, প্রিয় জাফর ভাই আর নেই। ১০ ফেব্রæয়ারি বুধবার দুপুর দেড়টায় হাজির হলাম। সঙ্গী ছিলেন যাঁর হাত ধরে সংবাদপত্রজগতে আসা সেই সাংবাদিক ম. নূরুল ইসলাম, তিনিও দৈনিক সংবাদ’র গৌরীপুর প্রতিনিধি, সাংবাদিকতার সার্বক্ষনিক সাথী দৈনিক ইত্তেফাক প্রতিনিধি মো. শফিকুল ইসলাম মিন্টু ও প্রেসকাবের নবনির্বাচিত সাধারণ সম্পাদক মশিউর রহমান কাউসার।
প্রিয় মানুষের আগমনে শালদিঘা নূর-মদিনা দরবার শরীফ চত্বরটি লোকে লোকারণ্য হয়ে উঠে। আফসোস ছিল সবার মাঝে, মুখে মুখে ছিল প্রয়াত মানুষটির সাথে তাদের স্মৃতির আয়নায় ভেসে উঠা মুহূর্ত আর কাজ গুলো। ছোট্ট শিশু থেকে বৃদ্ধ সকল মানুষের ভালোবাসায় সিক্ত হলেন আবু জাফর। স্মৃতিচারণ করতে গিয়েই কান্নায় মুষড়ে পড়েন সহকর্মীরা। নতুন পথ তৈরি করে সংবাদ মাধ্যমকেও সমৃদ্ধ করেছেন তিনি। সহকর্মীরা ছিল তাঁর প্রিয় বন্ধু। সদাহাস্য, সদালাপি, নির্লোভ মানুষটি মানুষের হৃদয়কে কতটুকু জয় করে নিয়েছিলেন তা ঠের পেলাম, যখন দেখলাম বাঁধভাঙ্গা জোয়ারের মতো মানুষের ঢল অশ্রæ ছলছল দু’চোখ নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। এ যেন সত্যের ছিঁটা বৃষ্টি। আমি নিজেও সংবরণ করতে পারলাম না আবেগকে, নিঃশব্দে টপটপ করে গড়িয়ে পড়ছে চোখের পানি, ভিজে গেল শার্টের কিয়দংশ। স্মৃতি চারণ করে বক্তব্য রাখেন সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান এরশাদ হোসেন মালু, গৌরীপুর প্রেসকাবের সাবেক সভাপতি ও দৈনিক সংবাদের প্রতিনিধি ম. নূরুল ইসলাম, পূর্বধলা প্রেসকাবের সাবেক সভাপতি লেখক আলী আহাম্মদ খান আইয়োব, গোয়ালাকান্দা ইউপি চেয়ারম্যান হাসনাত জামান খোকন, গোয়ালাকান্দা ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি আশরাফ আলী ফকির, গোয়ালাকান্দা ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান, জাবেদ আলী, সাঈদ আল মামুন শহীদ ফকির, অধ্যাপক আব্দুল কাদির, প্রয়াতের বন্ধু সাংবাদিক তিলক রায় টুলু ও আনোয়ার হোসেন। আজ সাদা কাপড়ে মোড়ানো, তিনিও নিঃশব্দে ছোট্ট খাটিলায় পড়ে আছে নিথর দেহটি। আল্লাহু আকবর, আল্লাহু আকবর ধ্বনিতে অনুষ্ঠিত হলো জানাযার নামাজ।
শেষ দেখার জন্য উৎসুক জনতার হুড়াহুড়ি চলছে, আমি ভাবছি অন্যটা। সেই মানুষটিকে আর বুঝি পাব না। ততক্ষণও ভাবছিলাম, এইতো জাফর ভাই আছেন! কিছুক্ষণের মাঝেই খাটিলার চারদিকে ধরেই কিছু মানুষ এগিয়ে চলছেন। আমরাও পিছু নিলাম, ক্ষনিকের মাঝেই গন্তব্য শেষ! আমাদের গর্ব, অহংকার, সম্পদ সবকিছু রেখে সাদা কাপড়ে জাফর ভাইকে মাটিতে শুয়ে দেয়া হলো। চলছে, বাঁশ-মাটির ঘরে চির-নিন্দ্রায় ঘুমানোর ব্যবস্থা। এরই ফাঁকে চোখের সামনে দেখলাম, জীবদ্দশায় কেটে যাওয়া গৃহটির দিকে।
সেই হাসির মানুষটি এই ঘরে থাকতেন, যেখানে বৃষ্টির পানি, কুয়াশা, সূর্য্যরে আলো আর রাতের কিরণ প্রবেশে কোন বাঁধা নেই! জঙ ধরা টিনগুলোও যেন আর্তনাদ করছে, আমাদের কবর দাও। আমরা তোমার রেখে যাওয়া সন্তানদের নিরাপত্তা দিতে পারব না। ঘরের খুঁটি নড়বড়ে। খসে পড়চ্ছে টিনগুলো। ক্ষমা করে দিও, জাফর ভাই! চলার পথে কখনও জানা হয়নি, অট্টহাসিতে লোকায়িত তোমারি হৃদয়ের কান্না। স্ত্রী-সন্তানদের এখানেই রেখে গেছো, সুখে থেকো তুমি। প্রার্থনা করি সৃষ্টিকর্তা যেন আপনাকে বেহেশেতের সর্বোচ্চ আসন যেন জান্নাতুল ফেরদৌউস প্রদান করেন। চৌচির কুটিরে রেখে যাওয়া, আমানতগুলোকেও তিনিই রক্ষা করবেন।
সহ¯্র মানুষের কষ্টের কথা লিখেছেন তিনি, কখনও নিজের কথা বলেননি। প্রশাসনের কর্তাব্যক্তি, রাজনৈতিক দলের কর্ণধার আর লাখো মানুষের কন্ঠ সাংবাদিক বন্ধুদের কাছের মানুষ ছিলেন তিনি। ক্ষমতায় থাকার দম্ভ কেউ দেখেননি। তিনি ১৯৮০সনে শ্যামগঞ্জ উচ্চ বিদ্যালয় থেকে এস.এস.সি, ১৯৮২সনে এইচ.এস.সি ও ১৯৮৪সনে গৌরীপুর কলেজ থেকে বিএ পাস করেন। ১৯৮৫ সনে দৈনিক আজকের কাগজের নেত্রকোনা জেলা প্রতিনিধি হিসাবে প্রবেশের মধ্য দিয়েই সংবাদপত্র জগতে তাঁর যাত্রা শুরু। এরপর দৈনিক সংবাদের শ্যামগঞ্জ প্রতিনিধি থেকে পূর্বধলা প্রতিনিধি হিসাবে কাজ করেন। ময়মনসিংহ থেকে প্রকাশিত দৈনিক জাহান পত্রিকারও আমৃত্যু প্রতিনিধি ছিলেন। ১৯৯৯সনের প্রথম দিনেই সহধর্মিনী হিসাবে মোছা. নাছিমা খাতুনের সঙ্গে আবদ্ধ হন। দাম্পত্য জীবনে বড় ছেলে আরিফ শাহরিয়ার নিলয় ৯ম শ্রেণিতে অধ্যয়নরত আর ছোট ছেলে আতিক শাহরিয়ার নাবিল দ্বিতীয় শ্রেণির ছাত্র। নাবিলের বাবা এখনও মারা যায়নি! কেননা জাফর ভাইয়ের নিথর দেহ দেখেও সে জানে না আর কখনও প্রিয় বাবাকে ‘বাবা’ বলে ডাকতে পারবে না। তাই নাবিল বাবার নাকের উপর হাত ধরে শ্বাস নিচ্ছে না কেন, তা পরীক্ষা করে দেখছিল। ছোট্ট শিশুটির এই দৃশ্য দেখে চোখের পানি কেউ ধরে রাখতে পারেননি। জানি, এই নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে গেলে আমিও ঘুমিয়ে যাবো, জাফর ভাইয়ের মতো একটি ছোট্ট খাটিলায়।
মফস্বলে সাংবাদিকতা এখন দুরুহ ব্যাপার। শিক্ষাগত যোগ্যতার মাপকাটি নেই। স্কুলের বারান্দায় গেলেও সনদ অর্জন হয়নি, এমন সার্টিফিকেটবিহীন কিছু মানুষের আগমনে, কলুষিত সংবাদমাধ্যম। ‘সাংঘাতিক’ শব্দের আনয়নকারী হলেও ওদের ভাব-সাব, খোদ সংবাদপত্রের মালিকের চেয়েও বেশি। ধান্দা-কতো কে জানে? তবে সেই ধান্দায় উজাড় হননি, এই আবু জাফর তালুকদার। হে আবু জাফর তালুকদার, স্যালুট জানাই আপনাকে, আপনার রেখে যাওয়া সততা, একনিষ্ঠ ও কল্যাণমুখী সংবাদ লিখনীকে। বিশ্বাস করি আপনার রেখে যাওয়া এক চিমটি সততা, এক মুঠো বস্তুনিষ্ঠতা ও আধা কেজি সাহসিকতার মিলনে তৈরি স্যালাইন প্রয়োগ করতে পারলে কলুষিত সংবাদ মাধ্যমের পাতলা পায়খানা দূর হয়ে যাবে! তিনি মানুষের হৃদয় স্পর্শ করেছিলেন, পকেট স্পর্শ করেননি। যার সম্মান রক্ষায় আপনি সচেষ্ট ছিলেন, জানি না, সেই সংবাদমাধ্যম ‘দৈনিক সংবাদ’ আজকের এই দিনে আপনার কর্মের মূল্যায়ন কীভাবে করবে? রেখে যাওয়া আপনার সংসারের সন্তানদের মাথায় ছাতার মতো ছায়া হবে কি না? দৈনিক সংবাদ- আপনাদের মতো সহ¯্র সংবাদকর্মীর কষ্টার্জিত ঘামের ওপর দাঁড়িয়ে আছে। হয়তো ছায়াটুকু দিবেন-সেই প্রত্যাশা স্বাভাবিকভাবেই রাখতে পারি।
প্রশ্ন এখন নিজেকেই করেছি, আমি কি পারব বন্ধু হিসাবে ওদের মাথায় ছায়া হতে। চারপাশে রেখে যাওয়া বন্ধু, রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব ও প্রশাসনের কর্তাব্যক্তিদের একটু সুনজর পাবে-কী এ পরিবারটি। ছোট্ট নাবিলের মাথায় হাত রেখে আদর করার সময়-আবারও চোখের অশ্রæ সংবরণ সম্ভব হয়নি। উপস্থিত সবাই ওদের মাথায় হাত রেখেই কথা বলেছি, সাহস দিয়েছি-পাশে থাকার অঙ্গিকারও করেছি। পূর্বধলার কর্মরত সাংবাদিকদের তাৎক্ষনিক প্রক্রিয়ায় আমি মুগ্ধ। উপস্থিত সবাই আবু জাফরের সৎ সাংবাদিকতার ভূয়সী প্রশংসা করেছেন। যাঁরা এই আবু জাফর তালুকদারকে একবার দেখেছেন, আশা করি কেউ ভুলব না। ওদের অশ্রæ মুছে দেয়ার দায়িত্বটুকু শুভানুধ্যায়ীগন নিবেন। আর যাঁরা সংবাদকর্মীদের চৌদ্দগুষ্টি উদ্ধার করতে মুখে ফ্যানা তোলেন, সেই সাহসী সমালোচকযুদ্ধাদের বলতে চাই, আসুন একবার আবু জাফর তালুকদারকে দেখুন, সত্যের একটি কলম কতো যুদ্ধ করে জীবনটা বাঁচিয়ে রেখেছিলো।
প্রত্যন্ত অঞ্চলের হে সাহসী কলমযুদ্ধা, আপনাকে লাখো সালাম, জাতির বিবেক স্বীকৃত এ পেশায় থেকে আপনি এ পেশাটি মহান করে রেখে গেছেন। আবারও আপনার বিদেহী আত্মার মাগফেরাত ও আপনার রেখে যাওয়া সন্তানদের যেন সৃষ্টি কর্তা সহায় হন সেই দোয়া করছি।###
মো. রইছ উদ্দিন, উপজেলা প্রতিনিধি, দৈনিক যুগান্তর, গৌরীপুর, ময়মনসিংহ, ০১৭১৮০৬৯২১০




Comments are closed.

     এই বিভাগের আরও খবর




অনলাইন জরিপ

জাতিসংঘের বিশেষ দূত এলিস ক্রুজ বলেছেন, বাংলাদেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির সুফল সব মানুষের কাছে পৌঁছাচ্ছে না। আপনিও কি তা-ই মনে করেন?

View Results

Loading ... Loading ...

পুরনো সংখ্যার নিউজ

রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি
 
১০১১
১২১৩১৪১৫১৬১৭১৮
১৯২০২১২২২৩২৪২৫
২৬২৭২৮২৯৩০৩১